ইসলামি ওয়াজের মাধ্যমে দেশজুড়ে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জিহাদি উন্মাদনা ছড়ানোর অভিযোগে একাধিক ইসলামী বক্তাকে খুঁজছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানিমূলক পোষ্ট ও ভিডিও ছড়িয়ে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত সাইবার জিহাদিদের বিষয়েও খোঁজখবর নেয়া শুরু হয়েছে। যদিও ফেইক আইডি ব্যবহার করে সাইবার জিহাদিরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পোষ্ট দিচ্ছে এবং কমেন্ট করছে, কিন্তু তাদের ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল ফোনের আইপি সনাক্ত করেই ওই অপরাধীদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া চলছে।
পুলিশ সুত্রে জানা গেছে, মুফতি আমির হামজা ও মাওলানা মাহমুদুল হাসান গুনবীসহ আরো কিছু বক্তা ওয়াজের নামে কথিত জিহাদের ডাক দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করে আসছেন। ধর্মের নামে অপব্যাখ্যা দিয়ে তারা কোমলমতি কিশোর-তরুণদের ব্রেনওয়াশের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ইউটিউবে ওয়াজের নামে উগ্রবাদ ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছেন এসব বক্তারা আর তাদের ভুল ব্যাখ্যায় মোটিভেটেড হয়ে অনেকেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি তারা তলোয়ার নিয়ে সংসদ ভবনে হামলা চালানোর চেষ্টারত সাকিব নামে এক যুবককে গ্রেফতার করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাকিব আলি হাসান উসামা জানায় এক ইসলামি বক্তার নির্দেশে সে এই পরিকল্পনা করেছিল। এছাড়া সে জিজ্ঞাসাবাদে আরও কয়েকজনের ওয়াজ ও বক্তব্য শুনে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হয়। আমরা সেসব ওয়াজকারীদের চিহ্নিত ও গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ মে সংসদ ভবন এলাকা থেকে সাকিবকে আটকের পর শেরেবাংলা নগর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় সাকিবসহ আলী হাসান উসামা ও মাওলানা মাহমুদুল হাসান গুনবীকে আসামি করা হয়। এছাড়া সাকিবের কাছ থেকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ‘সাকিব মোবাইল ফোনে উগ্রবাদ বার্তা সংবলিত ভিডিও প্রচারকারী আলী হাসান উসামা, মাহমুদুল হাসান গুনবী, আমির হামজা, হারুন ইজহার প্রমুখ ব্যক্তির উগ্রবাদী জিহাদি হামলার বার্তা সংবলিত ভিডিও দেখে উগ্রবাদে আসক্ত হয়’।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজের মাধ্যমে উগ্রবাদ ছড়ানোর পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবের মাধ্যমে প্রচারের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। চিহ্নিত কয়েকজন ইসলামি বক্তা ধর্মীয় প্রচারণার আড়ালে কৌশলে কথিত জিহাদ ও খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য তরুণদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। ইউটিউবে উম্মাহ নেটওয়ার্ক নামে একটি আইডি থেকে তামিম আল আদনানী নামে কথিত এক ইসলামি বক্তা নিয়মিত উগ্রবাদ সংবলিত বক্তব্য দিয়ে আসছেন।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, আলি হাসান উসামার মতো ওয়াজের নামে যারা প্রতিনিয়ত উগ্রবাদ প্রচার করে আসছেন তাদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকায় অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন ইসলামি বক্তার নাম রয়েছে।
এর আগে ২০১৯ সালের মার্চে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-২ থেকে ১৫ জন ইসলামি বক্তার একটি তালিকা তৈরি করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বক্তারা সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ, জঙ্গিবাদ, গণতন্ত্রবিরোধী ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী বয়ান দেন। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে সুপারিশও করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই তালিকায় যেসব বক্তাদের নাম ছিল সাম্প্রতিক সময়ে এদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। তবে এখনও বেশ কয়েকজন কথিত ইসলামি বক্তা নিয়মিত ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে জিহাদের ডাক দিয়ে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে অন্যতম দুই জন মাহমুদুল হাসান গুনবী ও মুফতি আমির হামজাকে আইনের আওতায় আনার জন্য গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক হেফাজতের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার অভিযানের কারণে এই দুজনও আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে খুব শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান একজন পুলিশ কর্মকর্তা।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, তালিকাভুক্ত বক্তাদের মধ্যে মাহমুদুল হাসান গুনবী ও মুফতি আমির হামজা সব ওয়াজেই জিহাদ, সাম্প্রদায়িকতা, নারীবিদ্বেষ, গণতন্ত্রবিরোধী, সরকারবিরোধী ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী বক্তব্য দিয়ে আসছেন। দুজনের মধ্যে আমির হামজা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, যারা কট্টর বয়ানের মাধ্যমে উগ্রবাদ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে না পারলে দেশে আবারও জঙ্গি হামলাসহ নানা সহিংসতার ঘটনা বেড়ে যাবে। এসব বক্তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোরআন হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যার বদলে তারা মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে এখনই জিহাদের সময় বলে তরুণদের ভুল পথে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
গ্রেফতার হবে সাইবার জিহাদিরা
গত মার্চ মাস থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছু ব্যক্তি ভারত ও নরেন্দ্র মোদী স্ট্যাটাস ও ভিডিও পোষ্ট করার মাধ্যমে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির পায়তারা করছেন। এদের মাঝে সরকারী কিছু কর্মকর্তাও আছেন। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট, ডিবিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এরই মাঝে এসব অপতৎপরতায় জড়িত অন্তত ২০০ জনের তালিকা তৈরী করেছেন, যেখানে বেশ কিছু নারী জঙ্গীও আছে। এসব তালিকা ধরেই এদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সংস্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে। বর্তমানে ওই ব্যক্তিদের ইন্টারনেট সংযোগের আইপি খতিয়ে দেখার পাশাপাশি ওদের অজ্ঞাতেই ওদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একাউন্ট গুলোর ফরেনসিক তদন্ত চলছে। কারণ, এরই মাঝে কিছু জঙ্গীবাদী প্রচারক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে তাদের জিহাদি স্ট্যাটাস ও ভিডিওগুলো ডিলিট করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের সামাজিক যোগাযোগ একাউন্টগুলোর গত ছয় মাসের সব পোষ্ট সম্পর্কে যাবতীয় প্রমাণাদি সংগ্রহ করা সম্ভব।