কথিত ই-কমার্স কোম্পানীগুলোর কাছে টিভি চ্যানেল, ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্ম ও এজেন্সীদের পাওনা কোটি-কোটি টাকা, সম্ভাব্য বিদেশী বিনিয়োগকারী কোম্পানী বিকল্প পথ খুঁজছে

0

বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে এক শ কোটি ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ দেখানোর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই কথিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি’র বিরুদ্ধে একের-পর-এক তথ্য মিডিয়ায় প্রকাশের প্রেক্ষিতে একটি বহুজাতিক এরই মাঝে টাকা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইভ্যালি কিংবা ধামাকা শপিং এর বদলে বিকল্প কোম্পানিতে বিনিয়োগের কথা ভাবতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের বিপুল সম্ভাবনার বিষয়ে বেশকিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ফলে একাধিক বিদেশী বিনিয়োগকারী এখন বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে বিনিয়গের বিষয়ে ভীষণ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রায় আঠারো কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে আগামী ৫-৭ বছরে ই-কমার্স সেক্টরে রীতিমতো বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে। এরই মাঝে সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবসা করে চালডাল-এর মতো প্রতিষ্ঠান বছরে শতশত কোটি টাকার ব্যবসা করছে এবং প্রতি বছর ওদের ব্যবসার আকার ১২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ১-২ বছরের মাঝেই বাংলাদেশের শীর্ষ অবস্থান দখল করতে পারা ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই বছরে অন্তপক্ষে ৫০-৬০ কোটি টাকা মুনাফা করতে পারবে। তারা বলছেন, এই সুযোগ কাজে লাগানো হয়তো ইভ্যালি কিংবা ধামাকা শপিংয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ এগুলো আদতে ই-কমার্সের নামে ফটকাবাজি এমএলএম কোম্পানী, যাদের মুখ্য উদ্দেশ্যই হলো নানা প্রলোভনে মানুষকে প্রতারিত করা।

এদিকে ইভ্যালির মালিক মোহাম্মদ রাসেল ও তাঁর স্ত্রী গ্রেফতার হওয়ার পর গ্রাহক ও ডিলারদের পাওনা শতশত কোটি টাকার বিষয়ে যখন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে তখন দেশের সিংহভাগ বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও নাটকের ব্র্যান্ডিং ও ব্যুকিং এজেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে গুরুতর অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। জানা গেছে শুধুমাত্র ইভ্যালিরই এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে  দেনা কোটিকোটি টাকা। পাশাপাশি অন্য আরো কিছু কথিত ই-কমার্স কোম্পানীর কাছেও এদের বিপুল অংকের টাকা পাওনা আছে।

জানা গেছে, ইভ্যালি মূলত পরিচালনা করেন রাসেল নিজেই। তাকে সহযোগিতা করেন তাঁর স্ত্রী শামিমা নাসরিন। আর ইভ্যালিতে গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ পদেই বসানো হয়েছে রাসেল এবং শামিমা’র আত্মীয় স্বজনদের।

এদিকে আরো জানা গেছে, রাসেল এর সাভারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গোপন সম্পদের দেখভাল করেন তাঁরই চাচাতো ভাই সেলিম, যিনি ইভ্যালিতে চাকরীও করেন। জানা গেছে চলতি বছরের মধ্যে ইভ্যালির আর্থিক ও আইনী সঙ্কট কেটে না গেলে রাসেল তাঁর স্ত্রীসহ গোপনে দেশ ছেড়ে পালানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। এক্ষেত্রে এই দম্পতি তিন লাখ মার্কিন ডলার দিয়ে ক্যারিবিয় একটি দেশের নাগরিকত্ব কেনার বিষয় চুড়ান্ত করে রেখেছিলেন। একবার দেশ থেকে পালাতে পারলে এই দম্পতি ক্যারিবিয় দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর তৃতীয় কোনও দেশে চলে যেতেন।

ইভ্যালির রাসেল কাহিনী

২০১৮ সালে পুরনো প্রতিষ্ঠান বিক্রির এক কোটি টাকা দিয়ে ইভ্যালির যাত্রা শুরু করেছিলেন মো. রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিন। রাসেল প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও নাসরিন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। বলতে গেলে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির হর্তাকর্তা তারা দু’জনই ছিলেন। শুরু থেকেই ইভ্যালি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। পণ্য পাওয়ার আশায় গ্রাহকের বিনিয়োগ করা টাকা দিয়েই ভাড়া করা অফিস, কর্মচারীদের বেতনসহ যাবতীয় সব খরচ চলতো। লাভ না হলেও দিনে দিনে খরচ ও দেনার পরিমাণ বাড়তে থাকে। নতুন গ্রাহকদের ওপর দায় চাপিয়ে পুরাতন গ্রাহকদের একটু একটু করে দেনা মেটানো হতো। বিশেষ বিশেষ দিবসকে সামনে রেখে বিভিন্ন লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহকের দৃষ্টি কাড়া হতো। ছাড়ের ছড়াছড়িতে অল্প সময়েই ৪৪ লাখের উপরে গ্রাহক হয়ে যায়। গ্রাহক যত বাড়ছিল দেনা তত বাড়ছিল।

একসময় এক হাজার কোটি টাকা দেনা হয়ে যায়। রাসেল ও তার স্ত্রী লোকসান হচ্ছে এটি বুঝতে পেরেও ব্যবসা বন্ধ করেননি। কারণ হঠাৎ করে ব্যবসা বন্ধ করলে বিনিয়োগকারীরা ঝামেলার সৃষ্টি করবে। আর দ্বিতীয়ত- রাসেল চেয়েছিলেন এশিয়ার মধ্য তার প্রতিষ্ঠানটির একটা ব্যান্ডভ্যালু তৈরি  হোক। যাতে করে ইভ্যালিকে সবাই একনামে চেনে। এর মাধ্যমে তিনি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিনিয়োগ করাতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি ঘন ঘন বিদেশে গিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। ইভ্যালিকে শেয়ার বাজারের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনাও ছিল। আর কোনো কিছু না হলে ইভ্যালিকে দেওলিয়া ঘোষণা করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করেছিলেন রাসেল। কিন্তু তাদের সব পরিকল্পনাই পণ্ড হয়েছে এক গ্রাহকের করা প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের মামলায় র‌্যাব’র হাতে গ্রেপ্তারের পর।

গুলশান থানার করা মামলায় র‌্যাব বৃহস্পতিবার মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে রাসেল ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে। র‌্যাব সদরদপ্তরের ওই রাতে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে গতকাল তাদেরকে গুলশান থানায় হস্তান্তর করেছে র‌্যাব।

রাসেল ও তার স্ত্রী নাসরিনকে থানায় হস্তান্তরের আগে র‌্যাব গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে। র‌্যাব সদরদপ্তরের ওই সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ইভ্যালি কারসাজির মূলহোতা রাসেল ২০০৭ সালে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করে ২০১৩ সালে এমবিএ করেন। ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করেন। পরে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি নেন। ৬ বছর চাকরি করার পর ২০১৭ সালে শুরু করেন এক বছর বয়সী শিশুদের একটি আইটেম নিয়ে ব্যবসা। ২০১৮ সালে ওই প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে ওই টাকা দিয়েই ইভ্যালি প্রতিষ্ঠার উদ্যেগ নেন। ধানমন্ডির ভাড়া করা জায়গা নিয়ে ইভ্যালির প্রধান কার্যালয় ও আরেকটি জায়গায় কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস চালু করেন তারা। একইভাবে ভাড়া নিয়ে আমিন বাজার ও সাভারে দু’টি ওয়ার হাউজ চালু করা হয়। কোম্পানিতে একপর্যায়ে ২০০০ স্টাফ ও ১৭০০ অস্থায়ী কর্মচারী ছিল। তখন কর্মচারীদের বেতন দেয়া হতো পাঁচ কোটি টাকা। ব্যবসায়িক অবনতির কারণে পরে সেটি ১৩০০ জন স্টাফ ও অস্থায়ী পদে ৫০০ কর্মচারীতে এসে দাঁড়ায়।

বেতনও এসে দাঁড়ায় দেড় কোটিতে। গত জুন মাস অনেক বেতন বকেয়া রয়েছে। পদাধিকার বলে রাসেল ও তার স্ত্রী মাসে ১০ লাখ টাকা বেতন নিতেন। তারা দু’জনে রেঞ্জ রোভার ও একটি অডি গাড়ি ব্যবহার করতেন। কোম্পানির জন্য ৩০টি গাড়ি বরাদ্দ ছিল। ইভ্যালির বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বর্তমানে ৩০ লাখ টাকা রয়েছে। এছাড়া কয়েকটি গেটওয়েতে গ্রাহকের ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা আটক হয়ে আছে।

মঈন বলেন, ইভ্যালি ছাড়াও রাসেলের আরও কয়েকটি ব্যবসায়িক প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। সেগুলো হলো- ই-ফুড, ই-খাতা, ই-বাজার ইত্যাদি। ইভ্যালির ব্যবসায়িক কাঠামো শুরু হয়েছিল নিজস্ব ইনভেস্টমেন্ট দিয়ে। তার ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি ছিল তৈরিকারক ও গ্রাহক চেইন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেয়া।

তিনি (রাসেল) বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর ক্যাশব্যাকের অফার নিয়ে সাধারণ জনগণকে প্রলুব্ধ করতেন। এভাবে দ্রুত ক্রেতা বাড়ানো হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ইভ্যালির গ্রাহক সংখ্যা ৪৪ লাখের বেশি। তিনি বিভিন্ন লোভনীয় অফারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে এত সংখ্যক গ্রাহক সৃষ্টি করেছেন। ইভ্যালির বিভিন্ন লোভনীয় অফারগুলো হলো- সাইক্লোন অফার (বাজার মূল্যের অর্ধেক মূল্যে পণ্য বিক্রয়); ক্যাশব্যাক অফার (মূল্যের ৫০-১৫০ শতাংশ ক্যাশব্যাক অফার) আর্থকোয়েক অফার, প্রায়োরিটি স্টোর, ক্যাশ অন ডেলিভারি। এছাড়া বিভিন্ন উৎসবেও ছিল জমজমাট অফার, যেমন-বৈশাখী ও ঈদ অফার ইত্যাদি। তাছাড়া আরও রয়েছে টি-১০, ৫ ও ৩ অফার। এভাবে বিভিন্ন অফারে প্রলুব্ধ হন সাধারণ মানুষ। বিক্রি বাড়ায় গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত চাহিদাও বাড়তে থাকে। সেক্ষেত্রে মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, এসি, মোটরবাইক, গাড়ি, গৃহস্থালি, প্রসাধনী, প্যাকেজ ট্যুর, হোটেল বুকিং, জুয়েলারি, স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রী ও ফার্নিচার পণ্যগুলো বেছে নেয়া হয়। এসব পণ্যের মূল্য ছাড়ের ফলে গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। এতে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির বিশাল আকারে দেনা তৈরি হয়।

মঈন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইভ্যালির দায় ও দেনা ছিল ৪০৩ কোটি টাকা। চলতি সম্পদ ছিল ৬৫ কোটি টাকা। বিভিন্ন পণ্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেয়া ২১৪ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন গ্রাহক ও কোম্পানির কাছে বকেয়া প্রায় ১৯০ কোটি টাকা। তবে র‌্যাব’র জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল জানিয়েছেন, তার দেনা এখন হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে লোকসানি এ কোম্পানিটি কোনো ব্যবসায়িক লাভ করতে পারেনি। গ্রাহকের অর্থ দিয়েই যাবতীয় ব্যয় ও খরচ নির্বাহ করায় দেনা বরাবর বেড়েছে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ইভ্যালির ব্যবসায়িক অপকৌশল ছিল, নতুন গ্রাহকের ওপর দায় চাপিয়ে পুরনো গ্রাহক ও সরবরাহকারীর দায়ের আংশিক করে পরিশোধ করা। অর্থাৎ দায় ট্রান্সফারের মাধ্যমে দুরভিসন্ধিমূলক অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছিলেন রাসেল। তিনি জানান, রাসেল ও তার স্ত্রীর ইভ্যালি প্রতিষ্ঠান চলতো পরিবার নিয়ন্ত্রিত পরিকল্পিত ব্যবসায়িক গঠনতন্ত্রে। একক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বেচ্ছাচারিতা দেখিয়েছেন তারা। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি ছিল। ফলে ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানের দায় বাড়তে বাড়তে বর্তমানে প্রায় অচলাবস্থায় উপনীত হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানায়, একটি বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফার (১:২) এর আলোকে ইভ্যালির ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেন রাসেল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির কাছে কোম্পানি শেয়ারের অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করে দায় চাপানোও ছিল পরিকল্পনার অংশ। এছাড়া তিন বছর পূর্ণ হলে শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দায় চাপানোর পরিকল্পনা নেন রাসেল। দায় মেটাতে বিভিন্ন অজুহাতে সময় বাড়ানোর আবেদনও একটি অপকৌশল মাত্র। সর্বশেষ তিনি দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া ঘোষণার পরিকল্পনা করেছিলেন। বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে তার প্রতিষ্ঠানকে বিক্রি করার চিন্তা করেছিলেন। এজন্য ঘনঘন বিদেশ গিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here