ঘুরে এলাম শতশত বছরের ঐতিহ্যবাহী ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ী

0

ভাটিপাড়ায় যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় বিকেল তিনটার একটু বেশী। গ্রামে ঢোকার পথেই বিশাল বাজার। তারপর একটা দিঘি। দিঘির উত্তর পাশে পিয়াইন নদী আর পূর্ব পাশে ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ী। পিয়াইন নদীর ঘাট থেকেই শুরু জমিদার বাড়ীর বিশাল কম্পাউন্ড। শুরুতেই ১৮৩০ দশকে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। আর শেষ প্রান্তে জমিদার বাড়ীর পারিবারিক কবরস্থান। এলাকাবাসী এটাকে ‘দরগাহ বাড়ী’ নামে ডাকেন – ফরিদুল আলম ফরিদ

বেশ ক’দিন যাবত সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলায় আছি পেশাগত কাজে। এরই মাঝে ভাটিপাড়ায় গিয়ে শতশত বছরের ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ী দেখে আসার ইচ্ছে মনে উঁকি দিচ্ছিলো। এই পরিবারের সন্তান, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী আমার আত্মার আত্মীয় – অতি আপনজন। ওনার সাথে আমার সম্পর্ক সেই ১৯৯৭ সাল থেকে। তখন তিনি বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এ-২১ এর কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। আমিও তখন ঢাকা শহরের মিডিয়ায় নতুন। একেবারেই নবাগত। তবু আমার প্রতি তাঁর ভালবাসা আর মমতার কমতি ছিলোনা। দেশের প্রথম বেসরকারী টিভি চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাতা হয়েও ওনার মাঝে ছিলোনা বিন্দুমাত্র অহংকার। এসব কারণেই আমার মাঝেও ওনার জন্যে একেবারেই অন্য রকমের একটা টান আর ভালোবাসার জন্ম নেয়। তিনিও আমায় আপন করে নেন নিজ সন্তানের মতো। দেখতে-দেখতে ২৪ বছরের বেশী অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। আমাদের সম্পর্ক এখনও অটুট। এই সম্পর্কে কোনও পার্থিব স্বার্থ নেই।

ঢাকার সাংবাদিক মহল কিংবা মিডিয়ায় শোয়েব চৌধুরী এক পরিচিত নাম। অনেকেই তাঁকে শ্রদ্ধা করে – ভালোবাসে। আবার কেউকেউ সমালোচনাও করে। তবে ওই সমালোচকদের ওনার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে-চোখ রেখে সমালোচনা করার সাহস নেই। ওনার সামনে গেলেই সমালোচকরাও ওনার ভক্তে পরিণত হয়ে যান, ওনার আন্তরিকতার কারণে।

ঢাকায় যারা শোয়েব চৌধুরীকে চেনেন-জানেন, কিংবা যারা ওনার কাছের মানুষ, ওনাদের অনেকেই জানেন না শোয়েব চৌধুরী সুনামগঞ্জ জেলার মানুষ কিংবা তিনি শতশত বছরের ঐতিহ্যবাহী জমিদার পরিবারের সন্তান। এটা উনিও কখনই কাউকে বলেন না। যদিও আমি বা আমরা হাতেগোনা কজন এটা অনেক আগে থেকেই জানি।  কিন্তু ক’দিন আগে ওনার একটা ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখে মিডিয়ার অনেকেই জেনে গেলেন শোয়েব চৌধুরী ভাটিপাড়া জমিদার পরিবারের সন্তান। আমিও ঘটনাচক্রে পেশার প্রয়োজনে দিরাই এসেছি বেশ ক’দিন হলো। হঠাৎ মনে হলো ঘুরে আসি ভাটিপাড়া। দিরাই থেকে সড়ক পথে ভাটিপাড়া যেতে চল্লিশ মিনিটের মতো সময় লাগে। ঈদের পরদিন চলেই গেলাম হুট করে। সাথে আমার বন্ধু মুস্তাফিজুর রহমান টিপু আর তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লন্ডন ফ্যাশনের স্টাফ রিমন। শোয়েব চৌধুরী জানতেন না আমার এই আকস্মিক সফরের কথা।

ভাটিপাড়ায় যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় বিকেল তিনটার একটু বেশী। গ্রামে ঢোকার পথেই বিশাল বাজার। তারপর একটা দিঘি। দিঘির উত্তর পাশে পিয়াইন নদী আর পূর্ব পাশে ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ী। পিয়াইন নদীর ঘাট থেকেই শুরু জমিদার বাড়ীর বিশাল কম্পাউন্ড। শুরুতেই ১৮৩০ দশকে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। আর শেষ প্রান্তে জমিদার বাড়ীর পারিবারিক কবরস্থান। এলাকাবাসী এটাকে ‘দরগাহ বাড়ী’ নামে ডাকেন।

পিয়াইন নদীর অন্য পাড়ে ভাটিপাড়া হাই স্কুল এবং ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স। এরপর হাজার-হাজার একর ফসলী জমি।

ব্রিটিশ শাসনামলে ভাটিপাড়া জমিদারদের এলাকা ছিলো বর্তমানের  দিরাই, জামালগঞ্জ, শাল্লা এবং তাহিরপুর এই চার উপজেলার বিশাল এলাকাজুড়ে। এই এলাকা মূলত হাওর কেন্দ্রীক। গোটা এলাকায় অনেকগুলো হাওর আছে, যেখানে শীত কালে আসে লাখলাখ অতিথি পাখি।

বহুতল ভাটিপাড়ায় প্রাইমারী স্কুলের নতুন ভবনের নির্মাণ হয় সরকারী  উদ্যোগে। এটির নীচতলা ও দোতলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র। আর উপরের তলা গুলোয় প্রাইমারী স্কুল। কেউকেউ আমায় বললেন এই নতুন ভবনের প্রতিষ্ঠাতা একুশে পদকপ্রাপ্ত খ্যাতিমান চিকিৎসক ডঃ এম ইউ কবির চৌধুরী। কিন্তু এটা একদম ভুল তথ্য। কবির চৌধুরী তাঁর মায়ের নামে ওই স্কুলের সামনে একটা তোরণ নির্মাণ করেছেন। ব্যস এটুকুই। সরকারী অর্থে নির্মিত স্কুলের সামনে একজন ব্যক্তির নামে কীভাবে তোরণ নির্মিত হলো এপ্রশ্নের উত্তর কারো কাছেই নেই।

ভাটিপাড়ায় প্রাইমারী স্কুলের পুরনো ভবনটি নির্মাণ করেন ভাটিপাড়ার জমিদার পরিবার। এই গ্রামে ভাটিপাড়ার জমিদারদের প্রতিষ্টিত হায়দরীয়া আলিয়া মাদ্রাসা এবং মঈনুল হক চৌধুরী মহিলা মাদ্রাসা আছে। হায়দরীয়া আলিয়া মাদ্রাসা’র প্রতিষ্ঠাতা তখনকার সিলেট বিভাগের অন্যতম চা বাগান মালিক ও ব্যবসায়ী গোলাম হায়দার চৌধুরী। তিনি ভাটিপাড়ার জমিদার আব্দুর রউফ চৌধুরী’র সন্তান। শোয়েব চৌধুরীর দাদা গোলাম আকবর চৌধুরীর আপন ছোট ভাই।

ভাটিপাড়ার মানুষদের কাছে জমিদার বাড়ীর নাম ‘সাব বাড়ী’ বা সাহেব বাড়ী। এলাকাবাসীরা জমিদার পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন।

শোয়েব চৌধুরীর আব্বা গোলাম আতহার চৌধুরী লেখাপড়া করেছেন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। থাকতেন বেইকার হোস্টেলে। বঙ্গবন্ধুর ক্লাসমেট ছিলেন তিনি। ভাটিপাড়ার মুরুব্বীদের মুখে এখনও গোলাম আতহার চৌধুরীর প্রশংসা। সবার কাছে তিনি ‘আতহার সাব’। অবসর পেলেই ভাটিপাড়া হাই স্কুলে যেতেন, ক্লাস নিতেন। সংস্কৃতিমনা আতহার সাহেবের উদ্যগে ১৯৭৩ সালের বসন্তে ভাটিপাড়ায় প্রথমবারের মতো বাসন্তী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ঢাকা থেকে মোহাম্মদ আলী, মিনা বড়ুয়া সহ অনেক শিল্পী অংশ নেন। তিনদিনব্যাপী ওই বাসন্তী উৎসবের স্মৃতি এখনও ভাটিপাড়ার মানুষদের মনে।

ভাটিপাড়া জমিদার পরিবারের দুই সন্তান্ত গোলাম সারোয়ার চৌধুরী এবং সাদাত বখত চৌধুরী চালচলনে ছিলেন ভীষণ কেতাদুরস্ত। দেখলে মনে হতো যেনো লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। এদের মাঝে সাদাত বখত চৌধুরী ভাটিপাড়া হাই স্কুলে প্রায় নিয়মিত পড়াতেন। আর গোলাম সারোয়ার চৌধুরী ছিলেন শিক্ষানুরাগী। এলাকাবাসীর জন্যে তাঁরই উদ্যগে হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ীর কম্পাউন্ডের প্রথমেই চোখে পড়ে বিশাল এক বাংলো ঘর। এটি ১৮১৯ সালের দিকে নির্মিত। বাংলো ঘরটার দিকে চোখ পড়তেই আমার মনে কেমন যেনো এক শিহরণ জাগলো। এখানে বসেই জমিদারী করেছেন শতশত বছর। বাংলোর পাশের দেয়াল ঘেষে আরেকটা আধুনিক ভিলা প্যাটার্নের বাড়ী। এটির মালিক সুজায়াত বখত চৌধুরী এবং তাঁর সন্তানেরা। এটা দেখে মনে হবে যেনো পশ্চিমা কোনও দেশে এসেছি। জমিদার সুজায়াত বখত চৌধুরী’র বাড়ীর ভেতরের বেডরুম আর খাবার ঘরেও গেলাম। লোকজন নেই। কেয়ারটেকার আছেন এসব দেখভাল করার। বর্তমানে সুজায়াত বখত চৌধুরী থাকেন সিলেটে আর ওনার সন্তানদের প্রায় সবাই ব্রিটেন-আমেরিকায়।

ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ীর কম্পাউন্ড ছয়ভাগে বিভক্ত। মসজিদ, উত্তরের বাড়ী, মাঝের বাড়ী, দক্ষিনের বাড়ী, কিনারের বাড়ী এবং দরগাহ বাড়ী। প্রত্যেকটা অংশেরই আলাদা বাউন্ডারী দেয়াল। চোখে না দেখলে বোঝাই যাবেনা কতো বিশাল এই জমিদার বাড়ীর আয়োতন।

জমিদার বাড়ীতে আমায় আতিথেয়তায় মুগ্ধ করলেন সাবির আলি এবং  রোকননুর। এদের কারো সাথেই আগে দেখা হয়নি। কিন্তু ওদের আন্তরিকতায় আমি এবং আমার সঙ্গীরা সত্যি মুগ্ধ হলাম।

এবার মনে প্রশ্ন জাগলো। আমার অতি প্রিয় শোয়েব চৌধুরী তো মিডিয়ায় আছেন। ওনার কোম্পানী এদেশের মিডিয়ায় এখন শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। তাহলে ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ীতে কেনো নাটক-সিনেমার শ্যুটিং হয়না? শোয়েব চৌধুরী তো ইচ্ছে করলেই এটা করতে পারেন। বাংলাদেশের মানুষও দেখতে পারতো এতো সুন্দর আর ঐতিহ্যবাহী লোকেশন। সাবির আলীর কাছেই জানলাম শোয়েব চৌধুরী প্রায় চল্লিশ বছর যাবত ভাটিপাড়ায় যানই নি। এখানকার তরুণ কিংবা যুবকদের অনেকেই ওনার নাম শুনলেও আজ অব্দি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই মানুষটাকে ওনারা দেখতেই পারেননি। মনেমনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আগামী শীতে শোয়েব চৌধুরীকে আমি এবং আমরা সবাই মিলে জোর করে হলেও ভাটিপাড়ায় নিয়ে আসবো।

ফেরার সময় নিজের মনকে বললাম, আবার আসবো ফিরে গ্রাম বাংলার এই হৃদয় ছোঁয়া পরিবেশে। সাথে শোয়েব চৌধুরী অবশ্যই থাকবেন।

ফরিদুল আলম ফরিদ নাট্য নির্মাতা এবং সাপ্তাহিক জনতার নিঃশ্বাস এর সম্পাদক

Please follow Blitz on Google News Channel

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here