ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের বিনোদন জগত

0

আজকাল অনেক শিল্পী ও নির্মাতাই নাটকে বাজেট কমের অভিযোগ তুলছেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো যে ক’জন হাতে গোনা শিল্পী নিজেদের মাঝে এক ধরনের অদৃশ্য সিণ্ডিকেট গড়ে নাটকের বাজেটের প্রায় ৬০ ভাগই নিজেদের পারিশ্রমিক হিসেবে নিয়ে নিচ্ছেন, তারাই বারবার বাজেট বাড়ানোর কথা বলছেন। অথচ এদের অযৌক্তিক পারিশ্রমিক প্রসঙ্গে কেউই কথা বলার সাহস করছেন না। এদের কাছেই মুলত গোটা নাটক সেক্টর জিম্মি হয়ে পড়েছে বলেও অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে নাটকের প্রযোজক সমিতি, ডিরেক্টারস গিল্ড এবং শিল্পী সমিতি একত্রিত হয়ে প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর পারিশ্রমিকের রেইট বেঁধে দিলে হাতে গোনা শিল্পীদের কবল থেকে গোটা সেক্টর পরিত্রান পাবে। পাশাপাশি অন্য সব শিল্পীরাও ন্যায্য পারিশ্রমিক পাবেন বলে অনেকেই মনে করেন। বাংলাদেশের বিনোদন জগত নিয়ে এটি লিখেছেন স্মৃতি সেন গুপ্ত

কাতরাতে-কাতরাতে শেষ অব্দি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সেক্টর সম্ভবত লাইফ সাপোর্টে আছে। এজন্যে কে বা কারা দায়ী এসব হিসেবনিকেশ করে এখন আর কোনই লাভ নেই। চলচ্চিত্র সেক্টরের কফিনে প্রথম পেরেকটা ঠুকেছিলো ইতর-শ্রেণির কিছু প্রযোজক, যাদের কারণেই কাটপিছ আর অশ্লীল সংলাপে ছেয়ে যায় সিনেমাগুলো। তারপর এলো ব্যাংক-লুটেরা আব্দুল আজিজের জাজ মাল্টিমিডিয়া। জনতা ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আট হাজার কোটি টাকার বেশী লোপাটকারী আজিজ সিনেমায় টাকা খাটয়েছিলো কলকাতার নির্মাতা, শিল্পী আর ওখানকার কিছু তৃতীয় সারির প্রযোজকের সাথে। নামেই বাংলাদেশী কোম্পানী। আসলে যৌথ প্রযোজনার নামে কলকাতার সিনেমা বাংলাদেশের হলগুলোয় চালিয়ে এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বনাশ করে জাজ মাল্টিমিডিয়া। আর আজিজের উদ্দেশ্য ছিলো সিনেমায় সামান্য টাকা খাঁটিয়ে প্রযোজক হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরির মাধ্যমে তাকে ব্যাংক থেকে হাজার-হাজার কোটি টাকা লোপাটে সাহায্যকারী ব্যাংক-কর্তাদের নিষিদ্ধ ফুর্তির ব্যবস্থা করা – বাংলাদেশে এবং দেশের বাইরে। এরই মাঝে আশাকরি এসব বিষয় চলচ্চিত্রের অনেকেই জানেন। আব্দুল আজিজ বা জাজ মাল্টিমিডিয়া বাংলাদেশের সিনেমার সামান্যতম উপকারেও আসেনি। ওরা সিনেমায় টাকা খাটিয়েছিলো ব্যাংকের টাকা লোপাটের প্রয়োজনেই।

যাক, সিনেমা নিয়ে আর কিছু বলার আপাতত প্রয়োজন নেই।

বাংলাদেশের, এমনকি পাশের দেশ ভারতের বিনোদন জগত যখন দীর্ঘস্থায়ী কোভিডের তাণ্ডবে ওলটপালট খাচ্ছে, তখন আমাদের টেলিভিশন নাটক সেক্টর শত বাঁধা অতিক্রম করেই জেগে উঠছে। ক’বছর আগেও যেখানে নাটকে বিনিয়োগ করে অনেকেই আসল টাকাই ফেরত পেতেন না, সেখানে এখন প্রায় প্রত্যেকটা নাটক থেকেই বিনিয়োগকৃত অর্থ লাভসহ ফেরত পাচ্ছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো।

এ মুহূর্তে বাংলাদেশের নাটকের সেক্টরে অন্যতম শীর্ষ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ক্রাউন এন্টারটেইনমেন্ট। ২০২০ সালের জানুয়ারী মাসে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠান মাত্র তিন মাসের মাথায় ধাক্কা খেলো করোনা মহামারীর তাণ্ডবে। কিন্তু এরা দমে যায়নি। দেশের অধিকাংশ প্রযোজক এবং প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান যখন করোনা আতংকে হাত গুটিয়ে বসে ছিলো, তখন ক্রাউন এন্টারটেইনমেন্ট একের-পর-এক নাটক, টেলিফিল্ম, বিশেষ দৈর্ঘের চলচ্চিত্র ও ধারাবাহিক প্রযোজনা করেছে। অনেকেই তখন ক্রাউন-এর সাহস দেখে বলেছিলেন, “এই কোম্পানি বড়জোর ছয়মাস টিকবে। কিন্তু ওদের ভবিষ্যতবাণী এরই মাঝে ভুল প্রমানিত হয়ে গেছে। করোনা সংকটকে তুচ্ছজ্ঞান করে ক্রাউন এন্টারটেইনমেন্ট তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার কারণেই আজ তারা মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। কেনো এই দুর্যোগের মাঝেই কোটিকোটি টাকা বিনিয়োগ করে ঝুঁকি নিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ক্রাউন এন্টারটেইনমেন্ট এর ডেপুটি সিইও তাজুল ইসলাম বলেন, ব্যবসা মানেই ঝুঁকি। আমি মনে করিনা নাটক সেক্টরে মন্দ সময়ের জন্যে কোভিড দায়ী। বরং এমন অবস্থা চলে আসছিলো দীর্ঘ সময় থেকেই। আমরা জানতাম এই মন্দা চিরস্থায়ী নয়। একারণেই ক্রাউন এন্টারটেইনমেন্ট কোভিড সংকটের মাঝেও বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। ফলাফল আমরা এখন পাচ্ছি। নাটকের সেক্টরে এরই মাঝে আশার আলো দেখা দিয়েছে। প্রযোজকরা এখন তাদের বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত পাচ্ছেন। আমার মনে হয় সামনে অবস্থার আরো উন্নতি হবে।

টেলিভিশন নাটকের ক্ষেত্রে স্পন্সরশীপ এবং ব্র্যান্ডিং অপরিহার্য। এক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলা নাটকের অন্যতম পৃষ্ঠপোষকের ভুমিকা পালন করছে ইভ্যালী এবং ধামাকা। এই দুই কোম্পানীই মুলত সিংহভাগ টেলিভিশন নাটকের স্পন্সর। তিনি বলেন, যেকোনো পন্য কিংবা সার্ভিসের প্রচারের ক্ষেত্রে সেরা মাধ্যম হলো নাটক। কারণ, নাটক স্পন্সরের মাধ্যমে প্রথমেই এটা কয়েক লাখ দর্শকের নজর কাড়ে টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারের সমইয়। এরপর বছরের-পর-বছর ইউটিউব চ্যানেলে প্রতিমাসেই বিপুল সংখ্যক মানুষ এই প্রচার দেখতে থাকেন।

নাটকের স্পন্সরশীপ কিংবা ব্র্যান্ডিং প্রসঙ্গে ক্রাউন ক্রিয়েশনস-এর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল বলেন, “ক্রমশ বিভিন্ন পন্য ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো টেলিভিশন নাটক স্পন্সর ও ব্র্যান্ডিংয়ের দিকে ঝুঁকছে। এটা খুবই ইতিবাচক দিক। আজ থেকে এক যুগ আগেও পন্যের প্রচারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনদাতারা প্রিন্ট মিডিয়াকে প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের ধারায় এখন সবাই আস্তে-আস্তে ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ার দিকেই আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন মোবাইল ফোনের ব্যবহারকারী দশ কোটির বেশী। এদের অধিকাংশই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ইউটিউবে নাটক বা অন্যান্য কন্টেন্ট দেখেন। এর ফলে ইউটিউবে পন্য কিংবা সেবার প্রচার ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

সৈয়দ ইকবাল বলেন, দেশের শীর্ষ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ক্রাউন এন্টারটেইনমেন্ট এর ‘ক্রাউন প্লাস’ নামে একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে, যেটির সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় দুই লাখ। প্রায় প্রতিদিনই সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা বাড়ছে। এই চ্যানেল মুলত মিউজিক ভিডিও নির্ভর। দেখা যাচ্ছে অনেক বিজ্ঞাপনদাতা কয়েক লাখ ভিউস হলেই মিউজিক ভিডিওগুলোও স্পন্সর করছেন। এটা অব্যাহত থাকলে আগামীতে দেশের সঙ্গীত সেক্টরও ঘুরে দাঁড়াবে বলে তিনি মনে করেন।

ক্রাউন এন্টারটেইনমেন্ট সম্পর্কে জানা যায়, এই প্রতিষ্ঠানটির নিজদের আধুনিক ক্যামেরা ইউনিট, এডিটিং প্যানেল, অডিও রেকর্ডিং ষ্টুডিও, ডাবিং ষ্টুডিওসহ সব ধরনের আধুনিক সরঞ্জামাদি নিজেদেরই আছে। বর্তমানে ক্রাউন এর মালিকানাধীন ‘ক্রাউন ডিজিট্যাল ষ্টুডিও’ টি নাটক ও চলচ্চিত্রের ডাবিং এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজে ভীষণ ব্যস্ত থাকছে। পাশাপাশি গানের রেকর্ডিংও হচ্ছে নিয়মিতভাবে।

তাজুল ইসলাম ও সৈয়দ ইকবাল বলেন, সরকারের উচিৎ নাটক শিল্পের প্রসারের লক্ষ্যে এই সেক্টরের জন্যে ন্যুনতম সুদে ব্যাংক ঋনের ব্যবস্থা করা। এটা করা হলে, এই সেক্টরে কর্মরত হাজার-হাজার মানুষ উপকৃত হবে।

তাঁরা বলেন, বর্তমানে অনেকেই নাটক নির্মাণে টাকা খাটানোয় আগ্রহী হয়ে উঠছেন, কারণ ব্যাংকে স্থায়ী আমানত থেকে বছরে যে পরিমান মুনাফা আসে এর প্রায় দ্বিগুণ টাকা আসে নাটকে টাকা খাটালে। কিন্তু এক্ষেত্রে, বিনিয়োগকারীদের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ। ভুঁইফোড় কোম্পানী কিংবা কোনও ব্যক্তি নির্মাতার পেছনে টাকা খাটালে সে টাকা মার যাওয়ার আশংকাই বেশী।

নাটকের বাজেট কমের অভিযোগ

আজকাল অনেক শিল্পী ও নির্মাতাই নাটকে বাজেট কমের অভিযোগ তুলছেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো যে ক’জন হাতে গোনা শিল্পী নিজেদের মাঝে এক ধরনের অদৃশ্য সিণ্ডিকেট গড়ে নাটকের বাজেটের প্রায় ৬০ ভাগই নিজেদের পারিশ্রমিক হিসেবে নিয়ে নিচ্ছেন, তারাই বারবার বাজেট বাড়ানোর কথা বলছেন। অথচ এদের অযৌক্তিক পারিশ্রমিক প্রসঙ্গে কেউই কথা বলার সাহস করছেন না। এদের কাছেই মুলত গোটা নাটক সেক্টর জিম্মি হয়ে পড়েছে বলেও অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে নাটকের প্রযোজক সমিতি, ডিরেক্টারস গিল্ড এবং শিল্পী সমিতি একত্রিত হয়ে প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর পারিশ্রমিকের রেইট বেঁধে দিলে হাতে গোনা শিল্পীদের কবল থেকে গোটা সেক্টর পরিত্রান পাবে। পাশাপাশি অন্য সব শিল্পীরাও ন্যায্য পারিশ্রমিক পাবেন বলে অনেকেই মনে করেন।

Please follow Blitz on Google News Channel

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here