বীরের জাতি বাঙ্গালী হারবেনা কোনো কিছুতেই

1

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের সব দেশই নানামাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এর ব্যতিক্রম নয়। ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। রাশিয়া এরই মাঝে ইউরোপের দেশগুলোয় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা যখন দিনে এক-দুবার লোডশেডিংয়ের কারণেই হাহুতাশ শুরু করেছি। কিন্তু একবার ভাবুন, আসন্ন শীত মৌসুমে পশ্চিমা দেশগুলোয় যখন রক্ত হিম করা ঠান্ডা পড়বে, তখন ওদের ঘরবাড়ীতে তাপযন্ত্র চলবেনা গ্যাসের অভাবে। আমরা লোডশেডিংয়ের কারণে গরমে কষ্ট করছি ঠিক, কিন্তু এরফলে অন্তত প্রাণহানীর কোনোই আশঙ্কা নেই। অথচ ইউরোপের দেশগুলোয় গ্যাসের অভাবে তাপযন্ত্র অচল থাকলে শতশত মানুষের মৃত্যু ঘটার প্রকট আশঙ্কা রয়েছে।

অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশ অচিরেই শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের মতো দেউলিয়া হতে যাচ্ছে। মহান স্রষ্টার ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে বলছি, বাংলাদেশ কখনো শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের মতো দেউলিয়া হবেনা। হওয়ার ন্যূনতম কারণ নেই। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যে পরিমাণ রিজার্ভ এখনও আছে সেটা দিয়ে আগামী ৭-৮ মাসের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা পূরণ সম্ভব। পাশাপাশি বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসছে প্রতি মাসেই। গতমাসেও দুই বিলিয়ন বা দুই শ কোটি ডলারের বেশী রেমিট্যান্স এসেছে। এটা অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি, ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকদের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ায় ফলে তাঁরা বিলাসী পোশাকের বদলে বেসিক পোশাকের দিকে ঝুঁকবেন। এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের চাহিদা অন্ততপক্ষে ২৫-৩০ ভাগ বাড়বে। তারমানে, আমাদের রপ্তানী আয় বাড়বে।

আমি বুঝিনা কেনো কিছু মানুষ বারবার বলছেন বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের মতো দেউলিয়া হয়ে যাবে। এটা কি রাষ্ট্রের প্রতি তাঁদের প্রতিহিংসা? আবারও বলছি, বাংলাদেশ কখনো শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের মতো দেউলিয়া হবেনা। তারপরও যারা ওমন দুর্গতি দেখার জন্যে মুখিয়ে আছেন, ওনারা ইচ্ছে করলে শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানে চলে যেতে পারেন। দেউলিয়াত্বের সাধ চাখতে।

যারা ভাবছেন  বিগত সরকারগুলো বুঝি দেশকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছিলো তাঁদের মনে করিয়ে দিতে চাই, ২০০৪-২০০৬ সালে ঢাকা শহরেই দিনে ৭-৮ বার লোডশেডিং হতো। কলকারখানাগুলো পড়েছিলো চরম সমস্যায়। তখন বিদ্যুৎ আসতো কম, যেতো বেশী। কারণ, ওই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কোনোই উদ্যোগ না নিয়ে বরং খাম্বা নামের একটা কোম্পানীকে হাজার-হাজার কোটি টাকা কামাই করার সুযোগ দিয়েছিলো গ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুতের খুঁটি বসানোর কাজ দিয়ে। হাজার-হাজার খুঁটি বসেছিলো, বৈদ্যুতিক তারও বসানো হয়নি।

ওই সরকার যখন ক্ষমতা ছাড়ে, তখন দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় তলানীতে ঠেকেছিলো। এসব কি সবাই এতো জলদি ভুলে গেলাম আমরা?

আজকাল বিরোধী দলের লোকজনেরা গলা ফাটিয়ে বলছেন, আওয়ামীলীগ সরকার নাকি ২০১৮ সালে ভুঁয়া নির্বাচন করেছে। একটু পেছনে তাঁকিয়ে দেখি তাহলে?

সামরিক শাসক হোসেন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনকালে যতোগুলো নির্বাচন হয়েছে সবগুলোই ছিলো ভোট ডাকাতির মচ্ছব। আজ কোন লজ্জায় জাতীয় পার্টি অবাধ নির্বাচনের কথা বলে? ওদের জমানায় কি একটা নির্বাচনও স্বচ্ছভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে?

এবার আসি বিএনপি প্রসঙ্গে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী কারা এক তরফা নির্বাচন করেছিলো? জাতি কি এসব মনে রাখেনি? ২০০৬ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি তাদের পছন্দের লোককে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করে একটা প্রহসনের নির্বাচনের অপচেষ্টা করেনি?

২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের পরামর্শে বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালো। শেখ হাসিনা নিজে ফোন করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানালেন আলোচনার। ওই সময় যদি খালেদা জিয়া আলোচনায় অংশ নিতেন তাহলে নির্বাচনে বিএনপি হয়তো বিজয়ী হতে পারতো। কিন্তু বিএনপিকে ওই নির্বাচন থেকে দূরে রাখে যুদ্ধাপরাধীর দল। কারণ, ওরা বিএনপির বদলে নিজেরাই ক্ষমতায় যাওয়ার মতলব আঁটছিলো।

এবার আসি তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রসঙ্গে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এধরনের তুঘলকি পদ্ধতি নেই। সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর ১৯৯০ সালে আসলে ক্ষমতাসীন সরকারের আকস্মিক পতনে যে শুন্যতার সৃষ্টি হয় সেটা নিরসনে কেয়ারটেকার কিংবা তত্বাবধায়ক সরকারের অস্থায়ী পদ্ধতি সব দল মিলে অনুমোদন করে। অনেকেই এখন বলছেন, ওই তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি নাকি হয়েছিলো সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে। এটা সম্পূর্ন ভুল। তখন তত্বাবধায়ক সরকার হয়েছিলো ক্ষমতাসীন সরকারের আকস্মিক পতনের শুন্যতা পূরণের মাধ্যমে দেশকে সাময়িকভাবে পরিচালনার স্বার্থে। তখন তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালু না করা গেলে দেশ হয়ে যেতো সরকারশুন্য। এটা কোনো দেশেই সম্ভব না। তাই, তত্বাবধায়ক সরকার তাঁদের দায়িত্ব পালনের একটা অংশ হিসেবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে। তারমানে, শুধুমাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালু হয়নি কখনোই।

এবার আমাকেই আপনারা বলুন, পৃথিবীর আর কোন দেশে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়? কোথাও না। আমেরিকা-ব্রিটেনেও না, পাকিস্তান কিংবা উগান্ডাতেও না। এক্ষেত্রে আমরা কেনো ওমন আজগুবি দাবী তুলছি? তাহলে কি আমরা বিশ্বকে দেখাতে চাই, আমরা হলাম আজগুবি এক জাতি, যাদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যে কেয়ার টেকার সরকার লাগে। এটা কোনো কথা হলো?

এবার আসছি দলীয়করণ প্রসঙ্গে। আমাদেরকে যারা গণতন্ত্রের সবক দিতে চায় সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে একটু তাঁকান। সেখানে তো পুরো প্রশাসনে ক্ষমতাসীন দলের লোকদেরই গুরুত্বপূর্ন সব পদে বসানো হয়। গত কদিন আগেই আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্টের বাসায় এফবিআই গেলো। তাঁর পুরো বাড়ীতে তল্লাশি চালালো। এমনকি ওই সাবেক প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর ওয়ার্ডড্রব তছনছ করা হলো। রাইফেল দিয়ে গুতিয়ে ড্রয়ার খোলা হলো। আলমিরার তালা ভাঙ্গা হলো। মানে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের ষোলোকলা চেষ্টা হলো। এদের কাছেও কি আমাদের গণতন্ত্র শিখতে হবে? গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সবক নিতে হবে?

আসুন আরো কিছু তথ্য জেনে নিই।

ওই দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আর তাঁর গুণধর ছেলে মিলে দেশের মজুত জ্বালানি বিক্রী করে দিলেন বিদেশের কাছে। কয়েক শ কোটি ডলার কমিশনের বিনিময়ে। ফলশ্রুতিতে ওই দেশে দেখা দিলো তীব্র জ্বালানী সংকট। এক গ্যালন পেট্রোল বিক্রী হচ্ছে পাঁচ ডলার বা ৫২০ টাকায়। তারপরও ওনাদের কাছেই কি আমাদের দুর্নীতিমুক্তির বয়ান শুনতে হবে?

সম্প্রতি আমেরিকার কংগ্রেসের স্পিকার তাইওয়ান সফরে গেলেন, রাষ্ট্রীয় চার্টার্ড বিমানে। ওই বিমানে তাঁর একমাত্র ছেলেকেও গোপনে নিয়ে যাওয়া হলো লিথিয়াম-এর কয়েক হাজার কোটি ডলারের ব্যবসা করিয়ে দিতে।

আরো শুনবেন?

আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর ব্যক্তিগত ইমেইলে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য লেনদেন করে স্পষ্ট দুর্নীতি এবং ভয়ংকর অপরাধ করলেন। কিন্তু ওনার এসব কীর্তি ধামাচাপা দিয়ে দেয়া হলো। একইভাবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুত্রের দুর্নীতি, মাদকাসক্তি, নারী আসক্তিসহ শতশত সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ধামাচাপা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে প্রকাশ্যে। কোনো রাখঢাক নেই। এদের কাছেই কি আমাদের নৈতিকতার তালিম নিতে হবে?

বাংলাদেশ কোনো অবস্থাতেই শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের মতো দেউলিয়া হচ্ছে না। হবেও না কখনো। আমাদের সবাইকে নেতিবাচক মনোবৃত্তি ত্যাগ করে ইতিবাচক হতে হবে। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে নির্বাচনে যেনো বিদেশীরা এসে নাক না গলায়। কারণ ওরা নাক গলাতে আসে গণতন্ত্র রক্ষা করতে নয়, আমাদেরকে ওদের হুকুমের গোলাম বানাতে। আমরা কি কারো গোলাম হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামবো?

সালাহ্ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী সিনিয়ার সাংবাদিক ও ব্লিটজ-এর সম্পাদক

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here