ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানী লিমিটেড (ডেসকো) এর উত্তরা অফিসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর ভয়ংকর অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এসব বিষয় জানেন না বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীসহ ওই মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। ডেসকো’র ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু দুর্বৃত্ত প্রতিষ্ঠানটিকে অনেকটাই মগের মুল্লুকে পরিণত করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, কোনো আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ অবৈধ পন্থায় ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানী লিমিটেড এর উত্তরা অফিসের কিছু সরকার বিরোধী কর্মকর্তা জঙ্গীবাদ ও বিএনপি-হেফাজত সংশ্লিষ্ট এক নারীর পক্ষাবলম্বন করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন এক গ্রাহক। এরই মাঝে ডেসকো উত্তরা অফিসের এসব বেআইনী কার্যকলাপের প্রতিবাদ করে আইনজীবীর মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিস পাঠিয়েছেন ওই গ্রাহক, যার অনুলিপি দেয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের। উল্লেখ্য, ওই নারীর পক্ষে বিএনপির কিছু লোকের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর দুর সম্পর্কের এক আত্মীয় তদবির করছেন।
ডেসকো’র প্রতি লিগ্যাল নোটিশ
এবিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক গত ৪ঠা মে ২০২১ তারিখে পাঠানো আইনী নোটিশ পাঠিয়ে জানিয়েছেন, ডেসকো কর্তৃপক্ষ যদি অবিলম্বে তাদের গ্রাহক নুরুদ্দিন মাহমুদ-এর উত্তরাস্থিত বাড়ী ২৩, সড়ক ১/এ, সেক্টর ৫ নীচতলা ও দোতলায় অবৈধভাবে নেয়া সংযোগ কিংবা প্রিপেইড মিটারে অবৈধভাবে রিফিল প্রক্রিয়া বন্ধ না করে সেক্ষেত্রে নোটিশ প্রাপ্তির তিনদিনের মধ্যে ডেসকো এর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা হবে, যেটায় অবৈধ সংযোগ নেয়া বা অবৈধভাবে প্রিপেইড মিটারে রিফিল সুবিধা গ্রহনকারী শাহানা রশিদ-সহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
“মিথ্যা তথ্য দিয়ে অবৈধভাবে প্রিপেইড মিটারে রিফিল চালু প্রসঙ্গে এডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক তাঁর পাঠানো লিগ্যাল নোটিশে বলেনঃ “অতঃপর নোটিশ দাতার দুই ভ্রাতা, সজল মাহমুদ অনি ও শ্যামল মাহমুদ অঞ্জন নোটিশ দাতার সত্ব দখলীয় নালিশী ফ্ল্যাট দখল করার পাঁয়তারা করিলে নোটিশ দাতা ঢাকার সহকারী জজ ২য় আদালতে দেওয়ানী ১৪/২০২১ নং মোকদ্দমা আনয়ন করেন। উক্ত মোকদ্দমায় অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করিলে বিজ্ঞ আদালত নোটিশ দাতা বাদী পক্ষে দখল বিষয়ে স্থিতিবস্থার আদেশ দেন। কিন্তু জনৈক শাহানা রশিদ উক্ত স্থিতিবস্থার আদেশের ভূল ব্যখ্যা করিয়া আপনার দপ্তরে এক আবেদন করিলে আপনার দপ্তর হইতে সংযোগটি পুনরায় চালু করেন।
“যেহেতু নালিশী ফ্ল্যাটের মালিক নোটিশ দাতা, উক্ত ফ্ল্যাটে বিদ্যুৎ সংযোগ গ্রহন করা বা না করা নোটিশ দাতার একান্ত ব্যক্তিগত আইনগত অধিকার। নোটিশদাতা ছাড়া অন্য কাহারো কোনো প্রকার অধিকার নাই। নালিশী ফ্ল্যাটের স্বত্ব দখল বিহীন শাহানা রশিদের আবেদনের পর নোটিশ দাতা আপনার দপ্তরে আইনজীবী মারফত প্রকৃত বিষয় অবগত করা স্বত্বেও আপনি বেআইনিভাবে অন্যায় ও অবৈধভাবে বিদ্যুৎ পুনঃ সংযোগ দিয়েছেন; যাহা বিদ্যুৎ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
“অতএব অত্র লিগ্যাল নোটিশ দ্বারা আপনাকে এই মর্মে নোটিশ করা যাইতেছে যে, অত্র নোটিশ প্রাপ্তির ৩ (তিন) কার্য দিবসের মধ্যে নোটিশদাতার আবেদন মোতাবেক বিদ্যুৎ সংযোগ ও মিটার বন্ধ রাখিবেন। অন্যথায় আমার মক্কেল আপনার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা সহ সকল প্রকার আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করার জন্য আমার উপর দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছেন”।
ডেসকো কর্মকর্তার সন্দেহজনক নীরবতা
গত ৯ই এপ্রিল, ২০২১ ডেসকো’র নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল), ইঞ্জিনিয়ার জগদীশ চন্দ্র মন্ডলকে ব্লিটজ একটি চিঠি পাঠায়। সেখানে লিখা হয় –
নিম্নে বর্ণিত তথ্যাবলী আপনার সদয় অবগতির জন্যে বিবৃত করছিঃ
১। উত্তরাস্থ বাড়ী নম্বর ২৩, সড়ক নম্বর ১/এ, সেক্টর নম্বর ৫, উত্তরা, ঢাকা বাড়ীটির নীচতলা ও দোতলার মালিক নুরুদ্দিন মাহমুদ (শাহীন) এর দরখাস্তের প্রেক্ষিতে তার ফ্ল্যাটগুলোয় প্রিপেইড মিটারের রিফিল বন্ধ করা হয় গত ১৮ই মার্চ ২০২১ তারিখে।
২। কিন্তু গ্রাহকের স্বার্থ উপেক্ষা করে উত্তরা অফিসের জনাব মোঃ জেলহাজ উদ্দিন, প্রকৌশল নির্বাহী মৌখিক নির্দেশের মাধ্যমে ওই বাড়ীর তিনতলা হতে ইলেক্ট্রিশিয়ান রাসেল (ডেসকো’র স্টাফ নয়) এর মাধ্যমে দোতলা ও নীচতলায় বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন করান, যা অদ্যাবধি বলবত আছে। আমার জানামতে, এধরনের সংযোগ বিদ্যুৎ আইন ২০১৮ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কেনো এবং কোন কারণে আপনাদের উত্তরা অফিস এধরনের বেআইনি নির্দেশ দিয়েছে সেটা আমাদের বোধগম্য নয়।
৩। উক্ত অবৈধ সংযোগের বিষয়ে আমাদের পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনার বরাবরে গত ২০শে মার্চ ২০২১ দুপর ২ টা ৩৮ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড এ একটি ইমেইল পাঠানো হয়। ওই ইমেইলের শিরোনাম (বিষয়) ছিলো – অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ প্রসঙ্গে পত্রিকার রিপোর্ট।
৪। আপনার কাছে পাঠানো উক্ত ইমেইলটি আপনাদের উত্তরা অফিস থেকে অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে আপনাদেরই কেউ শাহানা রশিদ এর কাছে ফাঁস করে দিয়ে সেটি ফেইসবুকে প্রচারের পরামর্শ দেন। এই ইমেইলটি শাহানা রশিদের ছোট ছেলে শ্যামল মাহমুদ তার ফেইসবুকে গত ২৩শে মার্চ প্রকাশ করে এবং এর ৩ দিন পর শাহানা রশিদ নিজেও এটি প্রচার করেন।
৪। আপনাদের উত্তরা অফিস কর্মকর্তাদের শাহানা রশিদ এর পক্ষাবলম্বন খুবই রহস্যজনক, কারণ, শাহানা রশিদ এবং তাঁর দুই ছেলে সজল মাহমুদ ও শ্যামল মাহমুদ সরকার বিরোধী তৎপরতার পাশাপাশি, জঙ্গিবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে আমাদের কাছে দালিলিক প্রমাণ আছে। শাহানা রশিদ ও তাঁর দুই ছেলের রাস্ট্র বিরোধী অপতৎপরতার বিষয় এরই মাঝে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তদন্ত করছে। এছাড়া, শাহানা রশিদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের বিরোধীতা করে তাঁর ফেইসবুকে পোষ্ট দেন এবং জিহাদের ডাক দেন, যা বাংলাদেশ ও বিদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
৫। আমাদের সিনিয়ার রিপোর্টার তাজুল ইসলাম গত ৭ই এপ্রিল জনাব জেলহাজ উদ্দিনের কাছে একটি ইমেইল পাঠান, যার অনুলিপি আপনাকেও দেয়া হয়। ওই ইমেইলে জনাব জেলহাজ উদ্দিন এবং তাঁর অধিনস্থ গোলাম কিবরিয়া সম্পর্কে আমাদের উত্থাপিত অভিযোগের কোনো উত্তর তাঁরা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, তাঁরা নিজেরাও জানেন, আমাদের উত্থাপিত অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে তথ্য নির্ভর। বিশেষ করে, জনাব জেলহাজ এবং কিবরিয়া কেনো এবং কোন কারণে আপনাকে পাঠানো আমাদের ইমেইল বাইরের লোকের কাছে পাচার করে সেটি ফেইসবুকে প্রচারের কুপরামর্শ দিয়েছেন, সেটার কোনই জবাব তাঁরা দিতে পারেন নি। এমনকি জনাব জেলহাজ উদ্দিন কেনো অবৈধভাবে উত্তরাস্থ বাড়ী নম্বর ২৩, সড়ক নম্বর ১/এ, সেক্টর নম্বর ৫, উত্তরা, ঢাকা বাড়ীটির তিনতলা ও চারতলার মালিক শাহানা রশিদকে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে বিদ্যুৎ লাইন দোতলা ও নীচতলায় সংযোগের অনুমতি দিলেন সেবিষয়েও কোন উত্তর আমরা পাইনি।
৬। শাহানা রশিদ এবং তাঁর দুই ছেলে সজল মাহমুদ ও শ্যামল মাহমুদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে।
ব্লিটজ-এর পক্ষ থেকে এই চিঠি পাওয়ার পরও কোনো উত্তরই দেননি ডেসকো’র নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল), ইঞ্জিনিয়ার জগদীশ চন্দ্র মন্ডল।
এদিকে ডেসকো এর উত্তরা অফিস সম্পূর্ণ অবৈধভাবে শাহানা রশিদ-এর পক্ষাবলম্বন করে উল্লেখিত বাড়ীর দোতলার প্রিপেইড মিটারের রিফিল চালু করে দিয়েছে, ওই ফ্লোরের মালিক এবং ডেসকো এর গ্রাহক নুরুদ্দিন মাহমুদের অজ্ঞাতেই, যা কেবলমাত্র অপরাধই নয়, বরং বিদ্যুৎ আইন ২০১৮ এর সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। কী কারণে ডেসকো এর উত্তরা অফিস এধরনের ভয়ংকর অনিয়ম আর অপরাধের সাথে জড়ালেন তা বোধগম্য নয়।
জানা গেছে, লিগ্যাল নোটিস প্রাপ্তির ৭২ ঘণ্টার মধ্যে উক্ত বাড়ীর দোতলা ও নিচতলার বৈদ্যুতিক সংযোগ গ্রাহক নুরুদ্দিন মাহমুদের আগের দরখাস্তের প্রেক্ষিতে পরবর্তী দরখাস্ত না দেয়া অব্দি স্থগিতাদেশ বলবৎ করার দাবী করা হয়েছে হয়।
কে এই গোলাম কিবরিয়া?
ডেসকো’র উত্তরা অফিসের এক কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া। জানা গেছে তাঁর সাথে সরকার-বিরোধী শাহানা রশিদ এবং তার সন্ত্রাসী পুত্রদের মাখামাখি। তিনি শুরু থেকেই সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে শাহানা’র পক্ষাবলম্বন করে আসছেন। এধরনের অবৈধ কাজে কম জাননি ডেসকো’র আরেক কর্মকর্তা জেলহাজ উদ্দিন। তিনি উত্তরার উল্লেখিত বাড়ীর নীচ ও দোতলার মালিক নুরুদ্দিন মাহমুদের দরখাস্তের প্রেক্ষিতে দুই ফ্লোরের বিদ্যুৎ মিটারের রিফিল বন্ধের ব্যবস্থা নেয়ার পর অত্যন্ত রহস্যজনক কারণে মৌখিকভাবে শাহানা-কে পরামর্শ দেন ওই বাড়ীর তিনতলা থেকে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ লাইন টেনে দোতলা ও নীচতলায় বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন করতে। এক্ষেত্রে তাঁরই পরামর্শে উত্তরা এলাকার এক ইলেক্ট্রিশিয়ানের মাধ্যমে এই অপকর্মটি করে শাহানা। কেনো এবং কোন আইনে জেলহাজ উদ্দিন এধরনের নির্দেশ দিলেন এটা ব্লিটজ এর সিনিয়ার রিপোর্টার তাজুল ইসলাম ফোনে জানতে চাইলে জেলহাজ উদ্দিন কোনও সদুত্তর না দিয়েই ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাথে জরুরী মিটিং করছেন এই অজুহাতে ফোন কেটে দেন। এরপর তাঁকে একাধিকবার ফোন কড়া হলেও তিনি আর কল রিসিভ করেন নি।
ডেসকো ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নীরবতা
ডেসকো’র উত্তরা অফিসে অনিয়ম সম্পর্কে একাধিকবার এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ইমেইল পাঠানো হলেও তিনি কোন উত্তর দেননি।
সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ডেসকো’র কর্মকর্তারা অজানা কারণেই সরকার-বিরোধী শাহানা রশিদের পক্ষাবলম্বন করছেন। এদিকে জানা গেছে, শাহানা’র পক্ষে তদবির করছে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর এক আত্মীয় এবং এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত এক নারী কর্মকর্তা।