আজকাল নাটকের মোট বাজেটের ৬০ ভাগই নিয়ে নেন সিন্ডিকেট গড়া কিছু কথিত বিশেষ শিল্পী। এদের সিন্ডিকেট এতই শক্তিশালী যে এরা রীতিমতো স্পন্সর ও টিভি চ্যানেলগুলোকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছেন। দক্ষ অভিনেতা ও অভিনেত্রী অথচ মন ও মননে স্বার্থান্বেষী ও পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব ফুটিয়ে তুলছেন।এতে আদতে তাদের কর্মবোধ ও ব্যক্তিত্বকে অনেকের কাছে ছোট করছেন। লিখেছেন মিঠা মামুন
সারাবিশ্বে কোথাও কোথাও করোনার প্রাদুর্ভাব এতটাই প্রকট হয়ে আছে যে সবাই এখনো ভয়ে থমকে আছে।
বাংলাদেশেও করোনা সংক্রমনের বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরোদেশ হতবম্ব হয়ে পড়েছে।জীবন ও জীবিকা বড় হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। কেউ কেউ বাঁচার তাগিদে যেন হাসতেও ভুলে গেছে।
তার মধ্যেও নাটক সিনেমার প্রেমে মশগুল মানুষ ও প্রিয়জনেরা অভিনয় শিল্পকে নিয়ে দিন রাত পরিশ্রম করছেন।মানুষকে বিনোদিত করে রাখার পাশাপাশি নিজের জীবিকা নির্বাহ প্রক্রিয়া চালিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন। করোন সংক্রমনের ভয়ও যাদের কর্মকে থামিয়ে রাখতে পারছে না তাদের জীবিকা নির্বাহের মানসিকতার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
এই বিপর্যয়ের ভেতর থেকেও বহু নাট্যপ্রেমী মানুষ নাটক নির্মাণের জন্য মুখিয়ে লিপ্ত আছেন।এটা নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। এক সময় ঈদে বিনোদনের মাধ্যম ছিল টিভি নাটক ও টেলিফিল্ম। সেই মোহমায়া এখনো আমাদের জড়িয়ে আছে। ইতোমধ্যে আসন্ন ঈদ-উল ফিতর উপলক্ষে কোন কোন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এবং কোন কোন নাট্যকার ও পরিচালকের নাটক নির্মাণের অত্যাধিক সংখ্যা দেখে মনে হচ্ছে এই করোনা বিপর্যয়ের ভেতরেও আমাদের ঈদ আনন্দ উৎসব ও বিনোদন থেমে নেই। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য সুখবরও বটে। যখন মানুষ গৃহবন্দি হয়ে পড়ে তখন আমরা অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি টেলিভিশনের প্রতি ঝুঁকে থাকি।বর্তমানে আমরা আনন্দচিত্ত নিয়ে বাংলাদেশের নাটকগুলোতে ঢুবে থাকতে গেলেও দেখতে দেখতেই একটা সময় বিরক্ত হয়ে পড়ি।পরিবার পরিজন নিয়ে নাটকগুলোতে আচ্ছন্ন হতে পারি না।নাটকের গল্প ও চরিত্রায়নে নতুনত্ব না পেয়ে একঘেয়েমি চেপে ধরে। নাটকগুলো যেন আমাদেরকে ধরে রাখতে পারছে না। নাটকের এই দুরাবস্থার জন্য যে বা যারা দায়ী তাদেরকে শোধরানো উচিৎ। বরং আরও প্রাণবন্ত ও নির্লোভচিত্তে নিজেদের কাজগুলোতে মনোনিবেশ করা উচিৎ বলে মনে করি।
বর্তমানে নাটক ও সিনেমার দুরাবস্থার কারণগুলো অনেকটা স্বচ্ছ বলে নির্দ্বিধায় এই সৃষ্টিশীল অভিনয় শিল্পকে সবাই নেতিবাচক মানসিকতায় বিদ্ধ করছে। এতে এই শিল্পে যারা প্রকৃত গুণ ও মানসম্পন্ন মানুষজন আছেন তারাও অকারণে এই করাল গ্রাসের স্বীকার হচ্ছেন।
আমার মনে হয় অভিনয় শিল্পের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে আরও দায়িত্বশীল এবং শিল্পমনা হওয়া উচিৎ।
আমরা একটা নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে দেখি একজন পরিচালক যখন গল্প ও চিত্রনাট্যের জন্য কিংবা অভিনয় শিল্পীর কাছে অভিনয়ের জন্য যান তখন তিনি তার প্রস্তাবিত কথার এক ফাঁকে বুঝিয়ে দেন এই নাটকের বাজেট খুবই কম। বুঝাতে চান এই নাটকে সবাইকে সম্মানির ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে কাজ করতে হবে।এই বিষয়টা অভিনয় শিল্পের জন্য খুবই বাজে এবং অশনি সংকেতও বটে।
অথচ খুঁটিয়ে দেখতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এক ঘণ্টার একটা নাটকের বাজেট প্রযোজক বিনিয়োগ করেছেন আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা অথচ পরিচালক কাজটা করার সময় সবাইকে বলে যাচ্ছেন দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। আবার কোন কোন প্রযোজনা সংস্থা নাট্যনির্মাণে টাকা বিনিয়োগ করেও অনেক নাট্যকার ও নাট্য পরিচালকের কাছে যেন ঘুরপাক খেতে থাকেন। আজকাল বহু প্রযোজনা সংস্থা ও এজেন্সিগুলো এবং বহু পরিচালকদের মধ্যে শিল্পসত্তার প্রচন্ড অভাব লক্ষ্যনীয় বরং শিল্পের নামে তাদের মধ্যে ঠিকাদার ব্যবসায়ীর মনোভাব একদম স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর বাজেট সম্পর্কিত এইসব আদর্শহীন কার্যকারিতায় আজ নাটক সিনেমা ধ্বংস হতে চলেছে এবং সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অভিনয় শিল্পীরা।
এইসব শিল্পজ্ঞানহীন চর্চা দমন করার ক্ষেত্রে করণীয় সবকিছু জেনেও যেন আমরা সবাই না জানার ভান করছি।
আজকাল নাটকের মোট বাজেটের ৬০ ভাগই নিয়ে নেন সিন্ডিকেট গড়া কিছু কথিত বিশেষ শিল্পী। এদের সিন্ডিকেট এতই শক্তিশালী যে এরা রীতিমতো স্পন্সর ও টিভি চ্যানেলগুলোকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছেন। দক্ষ অভিনেতা ও অভিনেত্রী অথচ মন ও মননে স্বার্থান্বেষী ও পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব ফুটিয়ে তুলছেন।এতে আদতে তাদের কর্মবোধ ও ব্যক্তিত্বকে অনেকের কাছে ছোট করছেন।
মূলত মূল্যবোধহীন চর্চার জন্য নাটক এবং অনেক অভিনয় শিল্পীদের জীবন আজ ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে। নাটক ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রকৃত মানুষগুলোর দূরাবস্থা রক্ষার্থে অভিনয় শিল্প সংঘ এবং ডিরেক্টর গিল্ডের কাছে প্রত্যাশা করছি তাদের কার্যকরী দায়িত্ব যেন আরও দৃঢ় ও সময়োপযোগী হয়।তাদের কার্যপ্রণালীতে আরও দূরদর্শিতা এবং বুদ্ধিদীপ্ত শিল্পমন ও মানসিকতা আশা করছি।তারা নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিচালক ও নাট্যভিনেতাদের নানামুখী সমস্যার জন্য আরও জুড়ালোভাবে এগিয়ে আসতে হবে । নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে বাজেট প্রক্রিয়াটা আরও স্বচ্ছ হওয়া উচিৎ।আমার মনে হয় নাটক নির্মাণের নিমিত্তে চিত্রনাট্য কোথাও পাঠানোর সময় চিত্রনাট্যতে যেভাবে নাটকের নাম, গল্প, চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালকের নাম লেখা থাকে তার পাশে বাজেটের পরিমাণটুকুও লেখা থাকা উচিৎ। এতে করে নাটকটি নির্মাণের সময় প্রযোজক ও পরিচালকের মনস্তাত্বিক গোজামিল কমে যাবে । পরিচালক ও প্রযোজকের স্বচ্ছতা দেখে নাটকটিতে যারা কাজ করবেন তাতে সবারই প্রাণবন্ততা ও আন্তরিকতা আরও বাড়বে।
নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে স্পন্সর ও চ্যানেলগুলোর চাহিদার মধ্যে আরও শিল্পবোধ বজায় রাখা উচিৎ। অভিনয় ও যোগ্যতার মধ্যে সমচিন্তার সমন্বয় ঘটানো উচিৎ। এখন একটা নাটকের জন্য একজন অভিনয় শিল্পীর বাজেট যদি মোট বাজেটের অর্ধেক হয়ে যায় তবে অন্যসব অভিনয়শিল্পী ও কলাকৌশলীর বাজেট প্রণয়নে পরিচালক ও প্রযোজকের অনেক সময় হিমশিম খেতে হয়।এক্ষেত্রে অভিনয় শিল্পী সংঘ ও ডিরেক্টর গিল্ডের নেতৃবৃন্দরা অভিনয় শিল্পীদের অভিনয় দক্ষতা অনুযায়ী প্রাপ্য সম্মানী নির্ধারণ করে দেবার রীতি চালু করে দিতে পারেন। এতে কেউ অন্যায় আবদার করে নাটকের নির্মাণে কারো দক্ষতা ও যোগ্যতাকে ঝুলিয়ে দিতে পারবেন না।
কোন সৃজনশীল মাধ্যম ধ্বংসের দিকে ধাবিত হলে এ থেকে পরিত্রানের জন্য সবাইকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসতে হয়।
কোন শিল্পমাধ্যমই একা কারো জন্য ধ্বংস হয় না। দিনশেষে তার দায় সবাইকেই নিতে হয়।
আমাদের দেশেও প্রচন্ড মেধাবী ও শিল্পবোধ সম্পন্ন মানুষ আছেন তাই আশা করি অবশ্যই আমরা নাটক সিনেমা জগতে ধ্বংসের ক্ষেত্র থেকে পরিত্রাণ পাবো।